বাক্য

সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি - | NCTB BOOK
78
78

বাক্যের সাধারণ গঠন: উদ্দেশ্য ও বিধেয়

হ্যাপি একটি পুতুল বানাতে চায়।

কাকিমা বলাইকে খুব ভালোবাসতেন।

লাইব্রেরি জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মানদণ্ড।

তখন আমার বয়স তেরো বছরের বেশি নয়।

তুমি কি লিখতে চাও ফুলের মতো কবিতা?

ভাষার মূল উপকরণ বাক্য। উপরের বাক্যগুলোতে পূর্ণাঙ্গ ও অর্থপূর্ণ বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত একাধিক পদ একত্রে মিলিত হওয়ার কারণেই বক্তব্য স্পষ্ট ও পরিপূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রতিটি বাক্যের বিভিন্ন পদের মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধ বা অন্বয় যেমন আছে, তেমনি আছে গঠনগত স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং বক্তব্যের অর্থবহতা। সুতরাং কোনো ভাষায় যে উক্তির সার্থকতা আছে এবং গঠনের দিক থেকে যা স্বয়ংসম্পূর্ণ, সে ধরনের একক উক্তিই ব্যাকরণ শাস্ত্রে বাক্য হিসেবে পরিচিত।

সংজ্ঞা: যে সুবিন্যস্ত পদসমষ্টি দ্বারা কোনো বিষয়ে বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়, তাকে বাক্য বলে।

যদি বলা হয় -
১. 'মৌলি একটি...।'
২. 'চাও মতো কবিতা ফুলের কি লিখতে তুমি?'
৩. 'মাছগুলো আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে।'

এগুলো বাক্যের মধ্যে পড়ে না। কারণ 'মৌলি একটি' বললে মনের ভাব অসম্পূর্ণ থেকে যায়। 'চাও মতো কবিতা ফুলের কি লিখতে তুমি?' এ ক্ষেত্রে অন্বিত পদগুলো খুবই বিযুক্ত। আর 'মাছগুলো আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে।' বললে অর্থগত ও ভাবগত সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। কারণ, মাছ কখনো আকাশে উড়তে পারে না। উদাহরণগুলো বাক্য হিসেবে সার্থক হবে, যখন বলা হবে-
১. মৌলি একটি পুতুল বানাতে চায়।
২. তুমি কি ফুলের মতো কবিতা লিখতে চাও?
৩. পাখিগুলো আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে।

বাক্যকে সম্পূর্ণ করার জন্য প্রয়োজন আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি। আর সুসংহত করার জন্য প্রয়োজন যোগ্যতা ও আসত্তি। সুতরাং একটি সার্থক বাক্যের ভিত্তি আকাঙ্ক্ষা, যোগ্যতা ও আসত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই তিনটি বিষয়ের কোনো একটির অভাব ঘটলে বাক্য নিরর্থক হয়ে পড়ে। সুতরাং সার্থক বাক্যের তিনটি গুণ থাকা আবশ্যক। যেমন:
১. আকাঙ্ক্ষা;
২. যোগ্যতা;
৩. আসত্তি।

১. আকাঙ্ক্ষা: বাক্যের অর্থ পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য এক পদের পর অন্য পদ শোনার যে ইচ্ছা, তা-ই আকাঙ্ক্ষা। যেমন: 'আমি গিয়ে দেখলাম'- এতে আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি হয় না। যখন বলা হয় 'আমি গিয়ে দেখলাম তারা চলে গেছে।' এখন এটি একটি বাক্য হলো। কেননা, এ কথা বলার পরে আর কিছু জানার আকাঙ্ক্ষা থাকে না।

২. যোগ্যতা: বাক্যের মধ্যকার পদসমূহের অন্তর্গত ও ভাবগত মিলবন্ধনের নাম যোগ্যতা। বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে বন্যা হয়। এটি একটি যোগ্যতাসম্পন্ন বাক্য। কিন্তু 'গ্রীষ্মকালে প্রখর রৌদ্রে বন্যা হয়।' বললে বাক্যটি অসংলগ্ন মনে হবে এবং ভাব প্রকাশের যোগ্যতা হারাবে। কারণ প্রখর রৌদ্রে কখনো বন্যা হয় না।

৩. আসত্তি: বাক্যের পদগুলোকে সঠিক জায়গায় সন্নিবিষ্ট করার নাম আসত্তি। অথবা, বাক্যের অর্থসংগতি রক্ষার জন্য সুশৃঙ্খল পদবিন্যাসই আসত্তি।

ছুটিতে ঢাকা তারা পুজোয় যাবেন এতে একটি সম্পূর্ণ বাক্যের সবগুলো পদই আছে, কিন্তু আসত্তির অভাবে বাক্য হয়নি। পদগুলো অর্থসংগতি রক্ষা করে ঠিকমতো সাজালেই বাক্য হবে। তারা পুজোর ছুটিতে ঢাকা যাবেন।

সাধারণত প্রতিটি বাক্যের দুটি প্রধান অংশ থাকে:
১. উদ্দেশ্য ও
২. বিধেয়

১. উদ্দেশ্য: বাক্যের যে অংশে যার সম্পর্কে কিছু বলা হয়, তাকে উদ্দেশ্য বলে।
২. বিধেয়: বাক্যে উদ্দেশ্য সম্পর্কে যা বলা হয়, তাকে বিধেয় বলে। যেমন: শ্যামা স্কুলে যায়।

এখানে 'শ্যামা' উদ্দেশ্য এবং 'স্কুলে যায়' বিধেয়। কারণ বাক্যটিতে 'শ্যামা' সম্পর্কে বলা হয়েছে। তাই 'শ্যামা' পদটি উদ্দেশ্য। বিধেয় হচ্ছে বাক্যের 'স্কুলে যায়' অংশটি। কারণ 'স্কুলে যায়' কথাটি শ্যামা সম্পর্কে বলা হয়েছে। বিধেয় অংশে অবশ্যই একটি সমাপিকা ক্রিয়া থাকে।

ভাষার সৌন্দর্য বর্ধনে কিংবা বক্তব্যের স্পষ্টতার জন্য বাক্য সম্প্রসারণের প্রয়োজন হয়। বাক্যকে সম্প্রসারিত করতে হলে উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের পূর্বে এবং পরে সেগুলোর পরিপোষক হিসেবে নানা রকম শব্দ যোগ করতে হয়। তবে উদ্দেশ্য ও বিধেয় সম্প্রসারণের রয়েছে কতিপয় নিয়ম।

সাধারণত বাক্যের কর্তৃকারকই মূল উদ্দেশ্য হয়। উদ্দেশ্যটি বিশেষ্য পদ হলে বিশেষণ বা অন্য কোনো পদ বা পদসমষ্টি দ্বারা উদ্দেশ্যের সম্প্রসারণ করা যায়। পক্ষান্তরে, সমাপিকা ক্রিয়াই বিধেয় অংশের মূল।

উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের সম্প্রসারণ

বাক্যে 'উদ্দেশ্য' প্রথমে ও 'বিধেয়' পরে বসে। বাক্য দীর্ঘ হলে উদ্দেশ্য ও বিধেয় সম্প্রসারিত হয়। যেমন:

উদ্দেশ্যের সম্প্রসারণ

সম্প্রসারণউদ্দেশ্যবিধেয়
রকিবেরভাইএসেছে
অত্যাচারীরাজানিহত হয়েছে

বিধেয়ের সম্প্রসারণ

উদ্দেশ্যসম্প্রসারণবিধেয়
ময়নাভালো জামগুলোখেয়ে ফেলেছে
তিনিযেভাবেই হোকআজ আসবেন

বাক্যের গঠনগত শ্রেণিবিভাগ (সরল, জটিল ও যৌগিক বাক্য)

গঠনগত দিক থেকে বাক্য তিন প্রকার। যথা:

১. সরল বাক্য
২. জটিল বা মিশ্র বাক্য ও
৩. যৌগিক বাক্য।

১. সরল বাক্য
যে বাক্যে একটিমাত্র কর্তা (উদ্দেশ্য) এবং একটিমাত্র সমাপিকা ক্রিয়া (বিধেয়) থাকে, তাকে সরল বাক্য বলে। যেমন:

ফুল ফুটেছে।
ছেলেরা খেলা করে।

এখানে 'ফুল' এবং 'ছেলেরা' কর্তা বা উদ্দেশ্য এবং 'ফুটেছে', 'খেলা করে' সমাপিকা ক্রিয়া বা বিধেয়।

২. জটিল বা মিশ্র বাক্য
যে বাক্যের মধ্যে একটি প্রধান বাক্য থাকে এবং একাধিক বাক্যকে প্রধান বাক্যের ওপর নির্ভরশীল দেখা যায়, তাকে জটিল বা মিশ্র বাক্য বলে।

অথবা, অন্যভাবে বলা যায়, যে বাক্যে একটি প্রধান খণ্ড বাক্যের এক বা একাধিক আশ্রিত বাক্য পরস্পর সাপেক্ষভাবে ব্যবহৃত হয়, তাকে জটিল বা মিশ্র বাক্য বলে।
যেমন:
যে পরিশ্রম করে, সে-ই সুখ লাভ করে।
যিনি সৎ পথে চলেন, তিনি সুখী হন।

আশ্রিত বাক্যপ্রধান খণ্ড বাক্য
যে পরিশ্রম করে,সে-ই সুখ লাভ করে।
যিনি সৎ পথে চলেন,তিনি সুখী হন।

৩. যৌগিক বাক্য
পরস্পর নিরপেক্ষ দুই বা ততোধিক সরল বা জটিল বাক্য মিলিত হয়ে যখন একটি সম্পূর্ণ বাক্য গঠন করে, তখন তাকে যৌগিক বাক্য বলে। যেমন:

তিনি অর্থশালী কিন্তু শিক্ষিত নন।

হিমেল নিয়মিত পড়াশোনা করে, তাই সে প্রথম হয়।

যৌগিক বাক্যের অন্তর্গত নিরপেক্ষ বাক্যগুলো ও, এবং, কিন্তু, অথবা, অথচ, কিংবা, বরং, তথাপি, সুতরাং, অতএব, যেহেতু, যেন প্রভৃতি অব্যয়যোগে সংযুক্ত থাকে।

বাক্য গঠনের নিয়ম

বাক্য গঠিত হয় শব্দ দিয়ে এবং বাক্যের অন্তর্গত প্রত্যেকটি শব্দকে বলা হয় পদ। বাক্যে ব্যবহৃত প্রত্যেকটি শব্দ বা পদ সাজানোর সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে। বাক্যে পদ সংস্থাপনার এ পদ্ধতিকেই বাক্যের পদ সংস্থাপন রীতি বা পদক্রম বলা হয়। ভাষার শুদ্ধ ও সার্থক প্রয়োগের জন্য পদ সংস্থাপনরীতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। বাক্যে পদের এলোমেলো ব্যবহার হলে মনের ভাব সার্থকভাবে প্রকাশিত হয় না। যেমন: 'ভাই দুই আমরা যাই ঢাকা' বললে কোনো অর্থ বোঝা যায় না, কিন্তু ঐ শব্দগুলো এভাবে পদক্রম অনুযায়ী সাজালে অর্থ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন: 'আমরা দুই ভাই ঢাকা যাই।'

বাক্যে পদ বসানোর কতিপয় প্রচলিত নিয়ম এখানে দেখানো হলো। যেমন:
১. বাক্যে সবচেয়ে প্রচলিত পদবিন্যাস হচ্ছে কর্তা প্রথমে, কর্ম মাঝে এবং ক্রিয়া শেষে। যেমন:
আমি বই পড়ি। সে বাড়ি যায়।
২. ক্রিয়া বিশেষণ ক্রিয়ার আগে বসে। যেমন:
রানা ডুকরে কাঁদছে। রহিত দ্রুত হাঁটছে।
৩. বাক্যে কর্ম থাকলে ক্রিয়া বিশেষণ কর্মের আগে বসে। যেমন:
মামুন নীরবে বই পড়ছে। শিক্ষক জোরে চাবুক কষছেন।
8. সময়বাচক ও স্থানবাচক পদ কর্মের আগে বসে। যেমন:
কাল কলেজ বন্ধ ছিল। আমি বৃহস্পতিবার ঢাকা যাব।
৫. না-বোধক অব্যয় সমাপিকা ক্রিয়ার পরে বসে। যেমন:
আমি খাইনি। কে পড়া শেখেনি?
৬. প্রশ্নবোধক সর্বনাম ক্রিয়ার আগে বসে। যেমন:
আপনি কী চান? আকাশে কী দেখছ?
৭. বিধেয় বিশেষণ বিশেষ্যের পরে বসে। যেমন:
ছেলেটা বুদ্ধিমান। লোকটি বোকা।
৮. বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সম্বন্ধ পদ বিশেষ্যের পরেও বসে। যেমন:
মুখটি তোমার কিন্তু সুন্দর। প্রাণ তার খুব শক্ত।

তবে মনে রাখতে হবে, এই পদবিন্যাস অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়। বক্তার মনোভাব, বলার বিশেষ ধারা বা স্টাইল ও পারিপার্শ্বিক বিষয়াদির ওপর নির্ভর করে পদবিন্যাস রীতি কেমন হবে।

common.content_added_and_updated_by

অনুশীলনী

73
73

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন: (নমুনা)

১। একটি সার্থক বাক্যের কয়টি গুণ থাকে?
ক. ২ টি
খ. ৩ টি
গ. ৪ টি
ঘ. ৫ টি

২। বাংলা বাক্যে ক্রিয়া পদ সাধারণত কোথায় বসে?
ক. বাক্যের শুরুতে
খ. বাক্যের মাঝে
গ. বাক্যের শেষে
ঘ. বাক্যের যে কোনো স্থানে

কর্ম-অনুশীলন

১। একটি সার্থক বাক্যের 'আকাঙ্ক্ষা', 'যোগ্যতা' ও 'আসত্তি' গুণের আলোচনা একটি পোস্টারে পরিসজ্জিত কর।

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion